Publish: Tuesday, 4 November, 2025, 7:54 AM				
				
								
				
			 
					
বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি একে ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করছে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন গত অক্টোবরের শেষ দিকে মার্কিন সিনেটের শুনানিতে এমন ঝুঁকির কথা বলেছেন।
বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা খাতে চীনের আধিপত্য রোধ করতে থিঙ্ক টোয়াইস অ্যাক্ট-২০২৫ নামে নতুন একটি আইন করছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বলা হয়েছে, চীন থেকে সমরাস্ত্র কিনলে নিষেধাজ্ঞাসহ অর্থনৈতিক বিধিনিষেধে পড়তে হবে। আগামী জানুয়ারিতে ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসন দায়িত্ব দিয়ে যখন ঢাকায় আসবেন, তখন এ আইন হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বৈশ্বিক অস্ত্র হয়ে উঠবে।      
চীনের ক্রমবর্ধমান সমরাস্ত্র বিক্রি বেইজিংয়ের বাড়তে থাকা সামরিক শক্তি এবং ভূরাজনৈতিক প্রভাবকে হুমকি হিসেবে মনে করছে ওয়াশিংটন। গত ২৩ জুলাই ১১০তম কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে থিঙ্ক টোয়াইস অ্যাক্ট-২০২৫ নামের আইনটি আনে ট্রাম্প সরকার। যার একমাত্র লক্ষ্য চীনের অস্ত্র বিক্রি মোকাবিলায় কৌশল নির্ধারণ এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে চীনের অস্ত্র কেনায় নিরুৎসাহিত করা।  
যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, অস্ত্রের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ৯ ধরনের সুবিধা আদায়ে সচেষ্ট চীন। এগুলো হলো সমরাস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি গঠন ও উন্নয়ন; বিভিন্ন পরিবেশে অস্ত্রের ব্যবহারের কার্যকারিতা ও মান নির্ণয়, যাতে ভবিষ্যতে চীনা সেনাবাহিনী তা ব্যবহার করতে পারে; যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত অংশীদারের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ানো; নির্দিষ্ট কিছু দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার জন্য আরও দৃঢ় অবস্থান তৈরি করা। 
এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং চীনের কূটনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব আরও সম্প্রসারণ করা; বিনিয়োগ ও কর্মীর সুরক্ষার জন্য চীনের অংশীদার সরকারগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা; বৃহত্তর ভূকৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য সংঘাতের প্রভাব বিস্তার; অংশীদার রাষ্ট্রগুলোর সামরিক অভিযান এবং সক্ষমতা উন্নত করা, যাতে চীন সীমান্তের অস্থিরতার মতো স্থানীয় সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে পারে এবং চীনের অস্ত্র ব্যবস্থার গবেষণা, উন্নয়ন ও উৎপাদনে অর্থ জোগান দেওয়া।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, প্রযুক্তির দিক থেকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে। এমনকি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উৎপাদনের জন্য বিরল ধাতুর প্রাপ্যতা তাদের বেশি। আর সমরাস্ত্র বিক্রির সঙ্গে ভূরাজনৈতিক প্রভাব তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল, কোয়াড গঠনসহ বিভিন্নভাবে চীনের গতি রোধ করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র পাল্টাপাল্টি শুল্কের চুক্তির বিষয়টি টেনে এ কর্মকর্তা বলেন, নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্টেও (এনডিএ) চীন থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে চূড়ান্ত চুক্তি যখন হবে, তখন এই ধারাটি না-ও থাকতে পারে। কারণ থিঙ্ক টোয়াইস অ্যাক্টের মাধ্যমে চীনের সমরাস্ত্র সংগ্রহকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসবে যুক্তরাষ্ট্র। এতে অন্য চুক্তিতে আর এটা রাখার দরকার হবে না। পাশাপাশি এনডিএতে চীনকে ঠেকাতে লগইংক ব্যবহারসহ বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে ওয়াশিংটন, যা বেইজিংয়ের সঙ্গে ব্যবসাকে প্রভাবিত করবে। কারণ, বাণিজ্যের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা এক করে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীন থেকে সমরাস্ত্র কেনা বা সংগ্রহ ঠেকাতে কৌশল নির্ধারণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু নতুন অস্ত্র নয়, পুরোনো অস্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশের বিক্রিও ঠেকাতে চায় দেশটি। এ জন্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহে আগ্রহী দেশগুলোকে মার্কিন আইন সম্পর্কে জানানো এবং চীনা অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাব্য ঝুঁকি বোঝানো হবে। পাশাপাশি বেইজিংয়ের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ক্রেতাদের লক্ষ্য করে নিষেধাজ্ঞা, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বা অন্যান্য অর্থনৈতিক বিধিনিষেধের ব্যবহার কার্যকর প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে কিনা– সেটাও বিশ্লেষণ করবে যুক্তরাষ্ট্র।
ঢাকার ঝুঁকি নিয়ে সিনেট শুনানিতে আলোচনা
গত ২৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে শুনানিতে অংশ নেন ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন। পেশাদার এ কূটনীতিক ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে রাজনৈতিক ও অর্থনীতিবিষয়ক কাউন্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নেব্রাস্কা থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান পার্টির সিনেটর পিট রিকেটস বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক, বিশেষ করে দুই দেশের ক্রমবর্ধমান সামরিক সহযোগিতা নিয়ে ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেনকে প্রশ্ন করেন। পিট রিকেটস বলেন, ‘আমরা যে আরেকটি হুমকির মুখোমুখি হচ্ছি, তা হলো কমিউনিস্ট চীন। বাংলাদেশ ও কমিউনিস্ট চীনের মধ্যে সামরিক পরিসরে সহযোগিতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি কমিউনিস্ট চীন একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি সাবমেরিন ঘাঁটি সংস্কার করেছে, যাতে যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন দুটিই রাখা যায়। আরও খবর এসেছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সর্বোচ্চ ২০টি চীনা নির্মিত জে-১০ যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। তারা নতুন সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল এবং দূরপাল্লার রাডারও সংগ্রহ করবে। এর মাধ্যমে তারা চীনা প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে আর্থিক ও কৌশলগতভাবে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপন করছে।’
বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনয়ন নিশ্চিত হলে কীভাবে আপনি বাংলাদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, যাতে তারা চীনা সমরাস্ত্রের ওপর আরও নির্ভরশীল না হয়, তাদের প্রতিরক্ষা ও ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার হয়?
জবাবে ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব নিয়ে আপনার উদ্বেগের সঙ্গে আমি একমত। আমার মনোনয়ন নিশ্চিত (রাষ্ট্রদূত হিসেবে) হলে বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলব– চীনের কর্মতৎপরতা, তাদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা, তাদের সামুদ্রিক এলাকায় কার্যক্রম ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় চীনের ভূমিকার ঝুঁকি স্পষ্টভাবে তুলে ধরব। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্বের সুযোগ ও সুফলগুলোও তুলে ধরব। বিশেষ করে আমাদের দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে আরও নিবিড় সহযোগিতার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেব।’
পিট রিকেটস বলেন, এই শুনানি এমন সময়ে হচ্ছে, যখন মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি ‘থিঙ্ক টোয়াইস অ্যাক্ট’ নামে একটি প্রস্তাব কণ্ঠভোটে অনুমোদন দিয়েছে। এই বিল অনুযায়ী, একটি পূর্ণাঙ্গ কৌশল প্রণয়ন করতে হবে, যাতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশকে চীনের কাছ থেকে অস্ত্র কেনা থেকে নিরুৎসাহিত করা যায়।
পিট রিকেটস বলেন, ‘এই বিল পাস করাটা অত্যন্ত জরুরি, যাতে আমরা অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মোকাবিলা করতে পারি। আশা করি, আমরা এই বিলের মাধ্যমে আপনাকে এমন একটি হাতিয়ার দিতে পারব, যা বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে আপনার কাজ করার সময় সহায়ক হবে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের অস্ত্র বিক্রির প্রভাব মোকাবিলায় আমরা আর কী কী করতে পারি? আপনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন?’
ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন বলেন, ‘আমাদের মার্কিন সামরিক সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে আমরা মিত্র দেশগুলোর জন্য তৈরি এমন কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তুলে ধরতে পারি, যা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তুলনামূলক সাশ্রয়ী হতে পারে। এতে যাদের যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনার সক্ষমতা নেই, তাদের আগ্রহী করা যাবে। পাশাপাশি আমরা যৌথ সামরিক মহড়ার মাধ্যমে এসব প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে পারি।’
ঢাকার স্বাধীন ও আত্মনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা বেইজিংয়ের
ঢাকায় গত শনিবার বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূতদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ফরমার অ্যাম্বাসাডরসের (এওএফএ) এক অনুষ্ঠানে মার্কিন উদ্বেগের বিষয়ে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, চীন বাংলাদেশের স্বাধীন ও আত্মনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা করে। এই নীতি বাংলাদেশের অতীতের সরকারগুলো অনুসরণ করে এসেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোনো বিদেশি শক্তির নির্দেশনায় পরিচালিত হয় না। চীনের অবস্থান হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীন ও নিজস্ব শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নীতি অনুসরণকে সমর্থন করা।
ডার্ক টু হোপ/এসএইচ