বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫,
৩ পৌষ ১৪৩২
বাংলা English हिन्दी

বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
মতামত
একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যা ও আজকে পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী নিধন একই সূত্রে গাঁথা
সুজিত রায় নন্দী
Publish: Wednesday, 17 December, 2025, 12:59 PM
বাংলাদেশের ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি ভৌগোলিক স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল না; এটি ছিল সাম্প্রদায়িকতা, সামরিক স্বৈরতন্ত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক প্রতিরোধ।

মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার এক ঘৃণ্য ও সুপরিকল্পিত চক্রান্তে লিপ্ত হয়। মহান বিজয় দিবসের মাত্র দুই দিন আগে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, বিজ্ঞানী, শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ—বিভিন্ন ক্ষেত্রের বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা এই পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হন।

উদ্দেশ্য ছিল একেবারেই স্পষ্ট—নবজাত রাষ্ট্র বাংলাদেশকে মেরুদণ্ডহীন করে তার অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ভিত্তি ধ্বংস করা। রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী এই নীলনকশা বাস্তবায়ন করে। এটি কোনো আকস্মিক প্রতিশোধ ছিল না; এটি ছিল ঠাণ্ডা মাথায় পরিচালিত একটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক গণহত্যা।

বুদ্ধিজীবীরা জাতির বিবেক। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেন, সমাজকে আলোকিত করেন চিন্তা, মনন ও মূল্যবোধের আলোয়। তাঁদের হত্যা ছিল কেবল কিছু মানুষকে হত্যা নয়; এটি ছিল একটি জাতির চিন্তা, প্রগতি ও ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ, চিন্তা ও দেশপ্রেম আজও বাংলাদেশকে পথ দেখায়।

স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর পর আজ আমরা ভিন্ন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছি। তবুও একটি প্রশ্ন আমাদের তাড়া করে—বুদ্ধিজীবীরা কি আজ সত্যিই নিরাপদ?
আজ আর হয়তো চোখ বেঁধে রায়েরবাজারে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয় না, কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের ওপর মব সন্ত্রাস, অপমান, ডিজিটাল হয়রানি, মিথ্যা মামলা, চাকরিচ্যুতি, চরিত্রহনন ও সামাজিক বয়কট ক্রমেই স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

যেসব বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িকতা, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কথা বলেন, তারা আজ নানামুখী চাপের মুখে পড়ছেন। কখনো “রাষ্ট্রদ্রোহী”, কখনো “ধর্মবিরোধী”, আবার কখনো “বিদেশি এজেন্ট”—এই তকমা লাগিয়ে তাঁদের কণ্ঠ রোধ করার অপচেষ্টা চলছে। এটি শারীরিক নয় শুধু, বরং মানসিক ও পরিকল্পিত বুদ্ধিবৃত্তিক নিধন।

১৯৭১ এবং বর্তমান সময়ের মধ্যে একটি গভীর যোগসূত্র রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই লক্ষ্য এক—বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, মানবিক বাংলাদেশকে ধ্বংস করা। যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাদের কাছে বুদ্ধিজীবীরাই সবচেয়ে বড় বাধা। ১৯৭১ সালে এই বাধা সরানো হয়েছিল হত্যার মাধ্যমে; আজ তা করা হচ্ছে ভয়, দমন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে।

এই বাস্তবতায় ১৪ ডিসেম্বর কেবল শোক পালনের দিন নয়; এটি প্রতিজ্ঞার দিন। আমাদের প্রশ্ন তুলতেই হবে—আজকের বুদ্ধিজীবীরা কতটা স্বাধীন? মত প্রকাশের পরিবেশ কতটা নিরাপদ? রাষ্ট্র ও সমাজ কি তাঁদের পাশে দাঁড়াচ্ছে, নাকি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে?

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে শুধু অতীত স্মরণ নয়; এর অর্থ বর্তমানের অন্যায়, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ। ১৯৭১ সালে শুরু হওয়া বুদ্ধিজীবী নিধনের রাজনীতি যদি আজও নতুন রূপে চলতে থাকে, তবে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

এই প্রেক্ষাপটে আরেকটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট—জনগণের আবেগ ও অনুভূতিকে বেয়নেট দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়। তারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার, গণমতকে বিভ্রান্ত করার এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে অচল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এটি কেবল রাজনৈতিক ছল নয়; এটি মূলত ইতিহাসের, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের এবং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।

বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে পরিণত করতে হলে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন করাই হোক শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অঙ্গীকার।

“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী—
ভয় নাই, ওরে ভয় নাই।
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান,
ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।”

শহীদ বুদ্ধিজীবীরা অমর।
তাঁদের আত্মত্যাগ বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

— সুজিত রায় নন্দী
সাংগঠনিক সম্পাদক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
মতামত লিখুন:
http://darktohope.org/ad/1763179181.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

লালবাগে প্লাস্টিকের গোডাউনে অগ্নিকাণ্ড, আড়াই ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে
বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করে যা বলল ভারত
থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে সংঘর্ষ: নিহত থাই বাহিনীর ১৯, কম্বোডিয়ার ১৭
সচিবালয়ে আন্দোলনকারী ১৪ কর্মচারী বরখাস্ত
প্রাথমিকের ‘মেধা যাচাই পরীক্ষা’ স্থগিত
মতামত- এর আরো খবর
Email: [email protected]
© 2024 Dark to Hope
🔝