এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় বন্যা ও ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত লাখো মানুষের কাছে পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছে উদ্ধারকর্মীরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট এই দুর্যোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে এক হাজার ৭৫০ ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ইন্দোনেশিয়ায় ভয়াবহ পরিস্থিতি
ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের আচেহ প্রদেশে এখন পর্যন্ত ৮৬৭ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছেন ৫২১ জন। একই সঙ্গে ৮ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। দেশটির আবহাওয়া দপ্তর আজ শনিবার (৬ ডিসেম্বর) পর্যন্ত আচেহে অতিভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে, যা উত্তর ও পশ্চিম সুমাত্রার জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
আচেহর গভর্নর মুজাকির মানাফ জানান, অনেক এলাকায় এখনও কোমরসমান কাদার মধ্যে মৃতদেহ খোঁজা হচ্ছে। তবে বর্তমান সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠেছে খাদ্য সংকট। তিনি বলেন, মানুষ বন্যায় নয়, অনাহারে মারা যাচ্ছে। দুর্গম বহু এলাকায় এখনও ত্রাণ পৌঁছানো যায়নি।
গভর্নরের ভাষ্য অনুযায়ী, আচেহ তামিয়াং অঞ্চলে সম্পূর্ণ গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, উপরে পাহাড় থেকে শুরু করে সড়ক হয়ে সমুদ্র পর্যন্ত সবকিছু ধ্বংস। বহু গ্রাম ও উপজেলাই এখন শুধু নামমাত্র অস্তিত্বে আছে।
শ্রীলঙ্কায় ৬০৭ জনের মৃত্যু
শ্রীলঙ্কায় সরকারিভাবে ৬০৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। আরও ২১৪ জন নিখোঁজ, যাদের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমারা দিসানায়েকে একে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে উল্লেখ করেছেন।
দেশটিতে এই দুর্যোগে ২০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র (ডিএমসি) জানিয়েছে, ৭১ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, এর মধ্যে প্রায় ৫ হাজার পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। ভারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় নতুন ভূমিধসের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং উদ্ধার ও পরিষ্কার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামেও প্রাণহানি
থাইল্যান্ডে বন্যায় অন্তত ২৭৬ জন নিহত হয়েছেন। মালয়েশিয়ায় দুইজন এবং ভিয়েতনামে আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে, যেখানে ভারি বর্ষণে বেশকিছু ভূমিধস ঘটেছে বলে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত সপ্তাহে একই সময়ে দুটি টাইফুন ও একটি ঘূর্ণিঝড় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আঘাত হানায় অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও ঘন ঘন ও তীব্র হচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় বিপর্যয় বাড়ার পেছনে অবৈধ বন উজাড় ও বৃক্ষনিধনও বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রেক্ষাপটে ইন্দোনেশিয়ার বনমন্ত্রী রাজা জুলি এন্তোনি শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) জানান, সরকার ২০টি কোম্পানির কাঠ কাটার লাইসেন্স বাতিল করেছে। এসব লাইসেন্সের আওতায় ছিল প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর বনভূমি, যার কিছু অংশ বন্যাকবলিত এলাকায় অবস্থিত।
পরিবেশমন্ত্রী হানিফ ফয়সোল নুরোফিক শনিবার (৬ ডিসেম্বর) উত্তর সুমাত্রার দুর্যোগকবলিত এলাকার উজানে অবস্থিত পাম তেল, খনি ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, বাতাং তোরু ও গারোগা জলাধার বাস্তুতাত্ত্বিক ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এখানে কোনো আপস করা যাবে না।
অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ফেবি দ্বিরাহমাদি বলেন, ঘন বনভূমি স্পঞ্জের মতো পানি শোষণ করে। বন উজাড় হলে ভারি বৃষ্টির পানি সরাসরি নদীতে ঢুকে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ও নির্বিচার বন উজাড়—এই দুইয়ের সম্মিলিত প্রভাবেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে এমন প্রাণঘাতী দুর্যোগ দিন দিন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
ডার্ক টু হোপ/এসএইচ