রবিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫,
২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English हिन्दी

রবিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশ
ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য
মেহেরপুর প্রতিনিধি
Publish: Monday, 1 December, 2025, 11:48 AM

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয় মেহেরপুরের মুজিবনগরে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়েছিল। সেই সরকারের শপথ নেওয়ার স্থান বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে গড়ে তোলা হয় মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স। সেখানে একটি মানচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো তুলে ধরা হয়। স্থাপন করা হয় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ম্যুরাল।

কমপ্লেক্সের সেই সৌন্দর্য এখন আর সেভাবে নেই। গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর ভাঙচুর হয় সেখানকার ছোট-বড় তিন শতাধিক ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরে যুদ্ধের বর্ণনা-সংবলিত ছোট ছোট ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকটি ভেঙে নিয়ে যায়। ১৫ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও সংস্কার কাজ হয়নি।

গত ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক বলেছিলেন, ‘ইতিহাস কখনও মোছা যায় না। ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় রাখতে হয়। মুজিবনগর সরকারের নাম পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছা নেই। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে কী করবে, এটি তাদের ব্যাপার। আমরা মুজিবনগরের নাম পরিবর্তন করিনি। এ দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিশ্বে সংযোগ স্থাপন করেছে মুজিবনগর সরকার। এটি প্রবাসী কিংবা অস্থায়ী সরকার নয়। এ সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তাই এই সরকার হচ্ছে সাংবিধানিক সরকার। এ সরকারের শপথ গ্রহণ একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বিশ্বজুড়ে এটি চিরকাল শ্রদ্ধা-ভালোবাসার মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হবে। 

উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম আরও বলেছিলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সে যে ক্ষতি হয়েছে, তা সংস্কার করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মোছা যায় না এবং এখানে কোনো কিছু আরোপ করা হবে না।’ 

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের কেয়ারটেকার সুভাষ মল্লিক বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে স্মৃতিসৌধ পরিচ্ছন্নতাসহ দেখভালের কাজ করি। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে ঐতিহাসিক এই স্থানে দর্শনার্থীরা ছুটে আসতেন। তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলে গর্ববোধ করতাম। তবে ৫ আগস্ট বিকেলে হামলার সময় আনসার সদস্যরা কমপ্লেক্স ছেড়ে চলে যান। পুলিশ আগেই থানায় ঢুকে আর বের হয়নি। তারা একে একে ভাস্কর্য ভাঙচুর করেছে। যে যেভাবে পেরেছে লাইট, সিসি ক্যামেরা, ব্যাটারি, পানির পাম্পসহ যা পেয়েছে, তা-ই খুলে নিয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ এভাবে লুট হতে দেখা কষ্টকর।  

গত বছরের শেষের দিকে কমপ্লেক্সের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে গণপূর্ত বিভাগ। সেই তালিকায় দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনাবহুল ও যুদ্ধের ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরতে কমপ্লেক্স এলাকায় ৬০০ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। নির্মিত ওই সব ভাস্কর্যের মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপর থাকা অন্তত ২০০টি ছোট ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। কমপ্লেক্সের সামনের অংশের বড় ভাস্কর্যের মধ্যে ৬৫টি ও পূর্ব গ্যালারির ভেতরে নির্মিত ৩৫টি ভাস্কর্য নষ্ট করা হয়েছে। 

ভাস্কর্যগুলো সংরক্ষণে লাগানো এসএস পাইপের পার্টিশন সব খুলে নিয়ে গেছে। কমপ্লেক্সটি আলোকিত ও দৃষ্টিনন্দন করতে লাগানো অন্তত ৫০০ এলইডি, আন্ডার ওয়াটার ও ফ্লাডলাইট লুট হয়েছে। ২০টি সিসি ক্যামেরা, তিনটি ক্যামেরা মনিটর, কম্পিউটার, আটটি পানির পাম্প, হাইভোল্টেজ ব্যাটারি, ক্যামেরা অ্যাডাপ্টর, এনভিয়ার, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার, অ্যাস্টন ও সিলিং ফ্যান লুট করা হয়েছে। 

মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার দেওয়া জীবিত দুজন ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিমুদ্দিন শেখ। সেই দিনের স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন,  ‘একাত্তরের ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যার পর মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হয়। এলাকার মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চেয়ার সংগ্রহ করি। রাত ১১টার পর ভারত থেকে অসংখ্য গাড়ি এসে আমবাগান ভরে গেল। প্রতিটা আমগাছের গোড়ায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনী সিভিল ড্রেসে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে পজিশন নিল। আমরা ভাবলাম, বড় কিছু হতে যাচ্ছে। সকালে এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আমাদের বললেন, তোমরা রাষ্ট্রীয় অতিথিদের গার্ড অব অনার দিতে পারবে? সকাল থেকেই দেশি-বিদেশি সাংবাদিকে ভরে গেল এলাকা। এক পর্যায়ে জাতীয় চার নেতা শপথ নিলেন। আমরা মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার দিলাম। অবশেষে ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা ও শপথ নেওয়ার মাধ্যমে গঠিত হলো মুজিবনগর সরকার। আম্রকাননে সগর্বে আত্মপ্রকাশ করল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য।’

আজিমুদ্দিন শেখ আক্ষেপ করে বলেন, ‘৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলো যারা ভাঙল, তারা বুঝল না– কী ভাঙল! মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স রাষ্ট্রের সম্পদ। একক কোনো দলের সম্পদ নয়। দেশের প্রায় সব দলেই মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। সব দলের উচিত রাষ্ট্রের সম্পদ, ইতিহাস-ঐতিহ্য বিনষ্ট না করে সংরক্ষণ করা।’     

গার্ড অব অনারে অংশ নেওয়া আরেক আনসার সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সেদিন ১২ জন গার্ড অব অনার দিয়েছিলাম। এর মধ্যে আমি ও আজিমুদ্দিন ভাই বেঁচে আছি। আমরা গর্বিত– স্বাধীনতার ইতিহাসে আমাদের নাম যুক্ত রয়েছে।’ 

সিরাজউদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবছর শীতের এই সময়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে মুজিবনগরে ছুটে আসত। তবে ভাস্কর্যগুলো ভেঙে ফেলায় ও কমপ্লেক্সের গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম লুট হওয়ায় এখন দর্শনার্থী তেমন আসে না। আমাদের দাবি, বিনষ্ট করে দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন আবার যাতে প্রতিস্থাপন করা হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।’ 

গণপূর্ত বিভাগ মেহেরপুরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গণপূর্তের আওতায় কমপ্লেক্সের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ঢাকা থেকে একটি টিম এসে পরিদর্শন করে গেছে। এসব ঠিক করতে ৬০ লাখ টাকা খরচ হবে মর্মে অর্থ বরাদ্দের জন্য চিঠিও দেওয়া হয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত ও বাজেট পাওয়া সাপেক্ষে কাজ করা হবে।’

মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কমপ্লেক্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পলাশ মণ্ডল বলেন, কমপ্লেক্সে সরকারের চারটি দপ্তর কাজ করে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত বিভাগ, জেলা পরিষদ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। কমপ্লেক্সে বিনষ্ট ও লুট হওয়ার বিষয়ে এখন দুটি বিভাগ কাজ করছে। ভাস্কর্য নির্মাণ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ে ভেঙে ফেলা ভাস্কর্যের তালিকা পাঠানো হয়েছে। অন্য বিষয়গুলো গণপূর্ত বিভাগ দেখছে।’

পলাশ মণ্ডল বলেন, ‘সরকার যেভাবে নির্দেশনা দেবে, সেভাবে কাজ করা হবে। বর্তমানে ৬০ আনসার সদস্য কমপ্লেক্সে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন। সঙ্গে ১৫ ট্যুরিস্ট পুলিশও আছে।

ডার্ক টু হোপ/এসএইচ 
মতামত লিখুন:
http://darktohope.org/ad/1763179181.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

বাংলাদেশে ৪ কোটি ২৫ লাখের বেশি শিশুকে টাইফয়েড টিকা দেওয়া হয়েছে: ইউনিসেফ
শ্রীলঙ্কায় বন্যা-ভূমিধসে নিহত বেড়ে ৬১৮, এশিয়াজুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
হাসপাতালে ভর্তি নচিকেতা
৫ কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের শাহবাগ অবরোধ
বিটিআরসির সামনে অবরোধ, বিক্ষোভ মোবাইল ব্যবসায়ীদের
বাংলাদেশ- এর আরো খবর
Email: [email protected]
© 2024 Dark to Hope
🔝